মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষের যে কোনো বৈধ অর্থনৈতিক কাজকেই ব্যবসায় বলে। অর্থাৎ কোনো কাজকে ব্যবসায় হতে হলে তার আইনগত বৈধতা অপরিহার্য। এই বৈধতা প্রমাণের সাথে দেশের আইনের যোগসূত্র রয়েছে । যদি কোনো ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও কার্যকরণ দেশের আইন বিরুদ্ধ হয় তবে তা ব্যবসায় হতে পারে না। ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করতেও আইন মানার প্রয়োজন পড়ে। এজন্য আইনে নির্দিষ্ট বিভিন্ন অানুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। ব্যবসায় সংক্রান্ত আইনের একটা বড় উদ্দেশ্য হলো ব্যবসায়ী ও এর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার যেন ভঙ্গ না হয় তা নিশ্চিত করা। তাই এরূপ অধিকার কী রয়েছে তাও ব্যবসায়ীদের জানার প্রয়োজন পড়ে। ব্যবসায় এখন আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই দেশের বাইরে ব্যবসায় করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশের ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রয়োজন পড়ে। তাই ব্যবসায়ের ইনগত দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্যই মূলত এ অধ্যায়ের অবতারণা ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)
১. ব্যবসায়ের বিভিন্ন আইনগত দিক ব্যাখ্যা করতে পারবে
২. পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক আইনের ধারণা ব্যাখ্যা করতেপারবে
৩. পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক এর সুবিধা বিশ্লেষণ করতে পারবে
৪ . পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক রেজিস্ট্রি করার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৫ . কপিরাইট আইনের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে
৬ . কপিরাইট নিবন্ধন করার পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে পারবে
৭. কপিরাইট ভঙ্গ করার পরিণতি বিশ্লেষণ করতে পারবে
৮. বিমার ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে
৯. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বিমা করার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে পারবে
১০. ব্যবসায় ও পরিবেশ আইনের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারবে
১১. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ করতে পারবে
১২. ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণরোধে করণীয় চিহ্নিত করতে পারবে
১৩. আই এস ও (ISO) ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবে
১৪. বি এস টি আই ধারণা ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করতে পারবে
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে কোনো বৈধ অর্থনৈতিক কাজকে ব্যবসায় বলে । এই বৈধতার প্রশ্নটি আইনের সাথে সম্পর্কিত । আইনে যে সকল ব্যবসায়কে বা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যকে অবৈধ বলা হয়নি তাই বৈধ ব্যবসায় হিসেবে গণ্য । তিন বন্ধু অংশীদারি চুক্তি করে চোরাচালানির ব্যবসায়ে নেমে পড়লো। এতে ব্যবসায়ের সকল বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকলেও আইনগতভাগে উক্ত কাজ বৈধ না হওয়ায় তা ব্যবসায় নয়। এভাবেই ব্যবসায় করতে হলে আইনে বিভিন্ন বিধি-বিধান মেনে চলার বাধ্য-বাধকতা আরোপ করা হয়েছে। কোম্পানি গঠন করতে হলে নিবন্ধন নিতে হয় । ব্যাংক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান সদস্য ভিন্ন জনগণ থেকে আমানত সংগ্রহ করতে পারে না- এগুলো আইনের বিধান। এখন যদি কোনো সমবায় সমিতি অধিক লাভ দেখিয়ে জনগণ থেকে আমানত সংগ্ৰহ করে তবে তা আইনগতভাবে বৈধ না হওয়ায় বৈধ ব্যবসায় হতে পারে না । ডেসটিনি, যুবক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বৈধ কার্যক্রম পরিচালনা না করায় তা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে এবং এ সকল প্রতিষ্ঠান জনগণের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে । বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসায় চালাতে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয় । নির্ধারিত মান অনুসৃত হবে এটা নিশ্চিত করার শর্তে মান বিষয়ক সনদে বাংলাদেশে BSTI-এর অনুমোদন লাগে। একজন একটা বই লিখলো । আরেকজন উক্ত বই হুবুহু নকল করে ছাপিয়ে বাজারে বাজারজাত করলো । এটা আইনের পরিপন্থি। লেখকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইনের বিধান রয়েছে । ইউনিলিভার ‘লাক্স' ব্রান্ড নামে বাজারে গায়ে মাখা সাবান বাজারজাত করে । আরেকজনও লাক্স নামে বাজারে সাবান বাজারজাত শুরু করলো । এক্ষেত্রে Lux ব্রান্ড নাম নিবন্ধিত করা থাকলে অন্যে তা ব্যবহার করতে পারবে না । যেই প্রতিষ্ঠান তার প্রয়াস-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গ্রান্ড নাম, লোগো ইত্যাদি জনপ্রিয় করেছে, তাদের পরিচিতির বাহন হিসেবে এগুলো তুলে ধরেছে তাদের সেই স্বার্থ সংরক্ষণে আইন রয়েছে । Bata একটা ব্রান্ড নাম। এখন একইভাবে মানুষকে প্রতারিত করার জন্য Bala, Beda, Rata ইত্যাদি নাম ব্যবহার করা হয় যা অন্যায় । গার্মেন্টস শিল্পে শিশু শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না এটা মেনেই এ ব্যবসায় চালাতে হয়। ইট ভাটা করতে হলে অধিক পরিবেশ দূষণ করে এমন চিমনি ব্যবহার করা যাবে না, শিল্প বর্জ্য শোধন করতে হবে, ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা যাবে না- এ সকল নানান বিষয়ে বিভিন্ন আইন দেশ ও জাতির স্বার্থে প্রবর্তন ও প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ বৈধতার সাথে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন আইন মেনে চলা প্রয়োজন । এ সকল আইন মিলিয়ে ব্যবসায়ের যে আইনগত দিক ফুটে ওঠে তাকেই ব্যবসায়ের আইনগত দিক বলে । তাই এ সম্পর্কে জানা ও মানা প্রত্যেক ব্যবসায়ীর জন্য অবশ্য করণীয় ।
আজকের শিল্পজগত যার আবিষ্কারের কাছে ঋণী তিনি হলেন শিল্প বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত স্কটিশ ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জেমস ওয়াট (James Watt) (১৭৩৬-১৮১৯)। তিনি প্রখ্যাত Glasgow বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি উৎপাদক হিসেবে কাজ করার সময় দেখতে পান যে, যে সকল ইঞ্জিন ডিজাইন ব্যবহার হচ্ছে তাতে ইনার্জির যথেষ্ট অপচয় ঘটছে এবং সিলিন্ডারকে বারে বারে ঠাণ্ডা করতে যেয়ে সময়েরও অপচয় হচ্ছে। তিনি | এমন একটা নতুন ডিজাইন উপস্থাপন করেন যেখানে আলাদা কনডেন্সার (Condenser) ব্যবহারের নির্দেশ করা হয় এবং ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এতে সময় ও শক্তির অপচয় ব্যাপক হ্রাস পায়। এতে নতুন ইঞ্জিন আবিষ্কারের ধারণা তার মধ্যে শক্তিশালী হয় । অতঃপর তিনি তার আবিষ্কারকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করার জন্য বিত্তবান ব্যক্তি মি. ম্যাথিউ বোল্টনকে পার্টনার করে সোহো ফাউথ্রি নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন । এখানেই গবেষণার মধ্য দিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হয়। এরপর এটি পেটেন্টের রাজকীয় সনদ লাভ করে । এরপর অনেকেই এই আবিষ্কারকে নকল করে এগুতে চেয়েছে কিন্তু প্রতিটা মামলায় রায় এসেছে জেমস্ ওয়াটসের পক্ষে। প্যাটেন্ট নামক এই আইনগত সুরক্ষা পরবর্তীতে হাজারো আবিষ্কারে মানুষকে উৎসাহ জুগিয়েছে। আর এভাবেই ঘটেছে শিল্প বিপ্লব ।
প্যাটেন্ট হলো নতুন আবিষ্কৃত ও নিবন্ধিত পণ্য বা বস্তুর ওপর আবিষ্কারকের এমন একচ্ছত্র অধিকার যার বলে তিনি এটি তৈরি, উন্নয়ন, ব্যবহার ও বিক্রয়ের একক অধিকার ভোগ করেন । এর বলে আবিষ্কারক অন্যকে লাইসেন্সও প্রদান করতে পারেন । কোনো আবিষ্কারকে প্যাটেন্ট সনদ পাওয়ার উপযোগী হতে হলে তাতে নিম্নের চারটি উপাদান থাকা আবশ্যক :
প্যাটেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রযুক্তি ও শিল্পের উন্নয়নে আবিষ্কারককে উৎসাহ প্রদান করা । এর ফলে আবিষ্কারক তার আবিষ্কারের সুফল ভোগের বিষয়ে যেমনি নিরাপত্তা বোধ করে তেমনি এটা দেখে অন্যরাও নতুন আবিষ্কারে মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত হয়। আইনানুযায়ী প্যাটেন্ট নবায়নযোগ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী প্যান্টেন্ট সনদ ১৭ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। বাংলাদেশে ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন প্রচলিত রয়েছে । এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্যাটেন্ট সনদের সময়কাল ১৬ বৎসর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ । উল্লেখ্য, ২০০১ সালে সরকার নতুন একটা প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইনের খসড়া প্রস্তুত করলেও অদ্যাবধি পার্লামেন্টে তা পাস হয়নি ।
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারায় নতুন আবিষ্কার ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে প্যাটেন্ট যে অনেক আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৃটেনকে আধুনিক সভ্যতার সুতিকাগার হিসেবে গড়ে উঠতে প্যাটেন্ট-এর যে মূল্যবান ভূমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য । চতুর্দশ শতকেই ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা প্যাটেন্ট সনদ চালু করেন। তখন নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি বা আমদানিকৃত প্রযুক্তির ওপর উদ্ভাবক বা আমদানিকারককে বিশেষ সংরক্ষণ অধিকার Letter of Patent মঞ্জুর করা হতো যাতে তাদের একক কর্তৃত্ব বজায় থাকে । বর্তমানকালে প্যাটেন্ট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। World Intellectual Property Organization (WIPO) কোনো দেশকে প্যাটেন্ট দেয়ার পূর্বে তা যেন আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ এবং যথাযথ Patent Documentation এর ব্যবস্থা করা হয় এজন্য চাপ দিচ্ছে । অর্থাৎ প্যাটেন্ট সববিচারে এখন প্রযুক্তির জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর সুবিধা তুলে ধরা হলো:
১. উদ্ভাবকের সুবিধা (Advantages of innovator) : প্যাটেন্টের মাধ্যমে একজন উদ্ভাবক প্রথমত তার কাজের আইনগত স্বীকৃত পায়। সেই সাথে অন্যদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সে মুক্তভাবে ও নিরাপদে এর ব্যবহার, ভোগ বা বিক্রয় করতে পারে। উদ্ভাবক প্যাটেন্ট নিবন্ধন পাওয়ার পর প্যাটেন্ট অফিস নিজ দায়িতেই তা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করে; যা উদ্ভাবককে এটি বিক্রয় ও রপ্তানিতে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এটি আবিষ্কারককে তার আবিষ্কার নিয়ে এগিয়ে যেতে ও নতুন নতুন আবিষ্কারে প্রণোদনা যোগায় ।
২. আমদানিকারকদের সুবিধা (Advantages of importer) : প্যাটেন্ট সনদপ্রাপ্ত নতুন প্রযুক্তি আমদানিতে আমদানিকারকগণ উৎসাহ বোধ করেন। আমদানিকারক যখন উদ্ভাবকের সাথে চুক্তি করে নিজ দেশে উত্ত প্রযুক্তির ব্যবহারপূর্বক উৎপাদন ও বিক্রয়ের নিরাপদ সুবিধা ভোগ করে তখন অন্যান্য দেশ থেকেও সে এভাবে প্রযুক্তি আমদানিতে উৎসাহিত হয়। আমদানিকারক প্রাপ্ত লাইসেন্স বলে উক্ত আবিষ্কারকে নিজ দেশেও প্যাটেন্ট। করতে পারে। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানের এ নিয়ে কোনো অন্যায় সুবিধা লাভের সুযোগ থাকে না ।
৩. অন্যান্যদের সুবিধা (Advantages of others) : প্যাটেন্টের ফলে আবিষ্কারের ওপর আবিষ্কারকের নিরঙ্কুশ অধিকার লাভের ফলে শুধুমাত্র আবিষ্কারকই উপকৃত হয় না অন্যরাও এরূপ আবিষ্কারে উৎসাহিত হয়। কষ্ট ও সাধনার মধ্য দিয়ে লেখা একটা বই যখন নকল হয়ে যায় বা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে অন্যরা এর সুবিধা ভোগ করে তখন লেখকই শুধু নয় অন্য নতুন লেখকরাও হতাশ হয় । তাই যদি এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকে তবে লেখকরা যেভাবে উৎসাহিত হয় প্যাটেন্টের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। বৃটেনে নতুন নতুন আবিষ্কারক সৃষ্টি হওয়ার পিছনে প্যাটেন্টের যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য ।
৪ রাষ্ট্রের সুবিধা (Advantages of state) : রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জনগণের জীবন মানের উন্নতি বিধান করা । এজন্য দেশের শিল্পখাত, কৃষিখাতসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন অপরিহার্য। এরূপ উন্নয়ন নির্ভর করে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর । নতুন আবিষ্কার যেমনি একটা জাতিকে উপকৃত করে তেমনি প্যাটেন্ট আমদানির সুযোগ থাকায় নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানির ফলে দেশ উপকৃত হয়। চীনের দ্রুত উন্নতির পিছনে বড় কারণ হলো নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানিতে তাদের ব্যাপক আগ্রহ। এতে তাদের দেশের আবিষ্কারকগণও উৎসাহিত হয়ে প্যাটেন্ট সুবিধার বিষয় মাথায় রেখে নতুন নতুন আবিষ্কারে এগিয়ে এসেছে। যা আধুনিক চীন গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
নতুন আবিষ্কারের মর্যাদা লাভের পাশাপাশি এর ওপর একচ্ছত্র অধিকার ভোগের জন্যই আবিষ্কারককে প্যাটেন্ট সনদ সংগ্রহ করতে হয়। প্যাটেন্ট নিবন্ধন পাওয়ার প্রথম অধিকারী হলেন এর আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক । উদ্ভাবক থেকে লাইসেন্সবলে প্রাপ্ত ব্যক্তিও প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। দেশে বা দেশের বাইরেও প্যাটেন্ট সনদের জন্য আবেদন করা যায়। নিম্নে বাংলাদেশে বহাল ১৯১১ সালের প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন অনুযায়ী প্যাটেন্ট নিবন্ধনের বিভিন্ন পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো :
১. আবেদন পেশ (Submission of application) : কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের হোন বা না হোন একলা বা কারও সাথে একত্রে প্যাটেন্ট নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফরমে ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে ফি সমেত প্যাটেন্ট নিবন্ধকের কার্যালয়ে আবেদন জমা দেবেন। যৌথ আবেদনের ক্ষেত্রে প্রথম আবিষ্কারক কে তার উল্লেখ করতে হবে। অন্য কেউ আবেদন করলে এরূপ আবেদন দাখিলের পক্ষে আবিষ্কারক বা তাদের পক্ষ থেকে যথাযথ অনুমোদন আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
২. আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা (Description of the nature of innovation) : আবিষ্কার সম্পূর্ণ অবস্থায় প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করা হলে আবিষ্কারের প্রকৃতি এবং যে পদ্ধতিতে তা সম্পন্ন করা হয়েছে ঐ পদ্ধতি বশদভাবে বর্ণনা করতে হবে। এছাড়া আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা করে স্বতন্ত্র বিবৃতিও দিতে হবে- যাতে সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার হিসেবে এটাকে নিরূপণ করা যায়। এক্ষেত্রে ডিজাইন বা ড্রয়িংও নিবন্ধক চাইতে পারেন। প্রয়োজন মনে করলে নিবন্ধক আবিষ্কৃত বিষয়বস্তুর নমুনা বা মডেল উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন। অসম্পূর্ণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করা যায়। সেক্ষেত্রে আবিষ্কারের প্রকৃতি বর্ণনা করে স্বতন্ত্র বিবৃতি নিতে হবে এবং আবেদনের তারিখ থেকে নয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ আবিষ্কার জমা দিতে হবে।
৩. আবেদনপত্র ও আবিষ্কার পরীক্ষা (Examining the application and innovation) : সম্পূর্ণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আবেদন পত্র ও এর সাথে প্রাপ্ত আবিষ্কারের প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্পর্কিত বর্ণনা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ডিজাইন ও ড্রয়িং, মডেল ও নমুনা বিষদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নিবন্ধক তা নিরীক্ষকের কাছে পাঠাবেন । নিরীক্ষক আবিষ্কারের প্রকৃতির সাথে পদ্ধতির মিল রয়েছে কি না, পদ্ধতিটি যথাযথভাবে বর্ণিত কি না, শিরোনামের সাথে যথাযথভাবে মিলে কি না, অঙ্কন ও মডেল যথার্থ কি না, অন্য কোনো আবিষ্কারের সাথে এর কোনো মিল রয়েছে কি না, এটি মৌলিক প্রকৃতির না অন্য কিছু ইত্যাদি বিষয় বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন । প্রয়োজনে নিরীক্ষক সংশোধনী আনার সময় দিবেন ও সংশোধিত বিষয়াদি পুনঃনিরীক্ষা করবেন।
৪. আবেদনপত্র গ্রহণ (Accepting application) : পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবেদন গ্রহণযোগ্য হলে নিবন্ধক উক্ত গ্রহণ বিষয়ে আবেদনকারীকে বিজ্ঞপ্তি দিবেন এবং এ বিষয়ে পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন প্রদান করবেন। যাতে এ আবিষ্কারের বিষয়ে যদি কারও কোনো অভিযোগ থাকে তবে সে তা উত্থাপন করতে পারে । এ ছাড়া জনগণকে দেখা ও পরীক্ষা করার জন্য আবেদনপত্র, এর বিষয়বস্তু, পদ্ধতিগত বর্ণনা, ডিজাইন, ড্রয়িং, মডেল ইত্যাদি যেখানে যতটা প্রযোজ্য পরিদর্শনের নিমিত্তে খোলা রাখার ব্যবস্থা করবেন।
৫. প্যাটেন্ট বা নিবন্ধন পত্র প্রদান (Issuing patent or registration letter) : কোনো দিক থেকে কোনো বিরোধিতা লক্ষ না করলে বা বিরোধিতার ক্ষেত্রে তা উপযুক্ত বিবেচিত না হলে নিবন্ধক তার অফিসের সীলমোহর করা প্যাটেন্ট সনদ এর গ্রহীতাকে প্রদান করবেন। এরূপ সনদ এর আবিষ্কারককে সমগ্র বাংলাদেশে তার আবিষ্কার তৈরি, বিক্রয়, ব্যবহার এবং অন্যকেও এরূপ করার লাইসেন্স প্রদানের একছত্র অধিকার প্রদান করবে। এরূপ প্যাটেন্ট শুধুমাত্র একটি আবিষ্কারের জন্যই প্রদত্ত হবে এবং প্যাটেন্টের তারিখ থেকে তা ১৬ বৎসর সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে ।
আরিয়ান টিভিতে একটা নতুন বিজ্ঞাপন দেখছে। সে প্রথম দিকে বুঝে উঠতে পারেনি এটা কিসের বিজ্ঞাপন। পরে বুঝলো বিজ্ঞাপনটি একটা মোবাইল ফোন কোম্পানির। কারণ তিনটা পাখা সম্বলিত একাধিক ছবি ভেসে আসলো । আর এতেই তার বুঝতে বাকি থাকলো না এটা গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন । শুভ্র খেলতে ভালোবাসে । তার গায়ের গেঞ্জি, পায়ের কেস, মাথার টুপি-সর্বত্রই হকি খেলার ব্যাটের ন্যায় চিহ্ন । এটা নাইকি নামক নামকরা খেলার সামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লোগো বা প্রতীক। এই চিহ্নগুলোর সবই কোনো কোম্পানির পণ্যের মালিকানা নির্দেশ করে। যা ট্রেডমার্ক নামে গণ্য ।
ট্রেডমার্ক হলো পণ্য বা ব্যবসায়ের এমন কোনো স্বতন্ত্রসূচক বৈশিষ্ট্য, চিহ্ন বা প্রতীক যা সকলের নিকট ব্যবসায় বা পণ্যকে সহজে পরিচিত করে তোলে এবং এর মালিকের তা ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার নির্দেশ করে। মার্ক বলতে সাধারণত কোনো নিশানা, ছাপ বা চিহ্নকে বুঝায় । বাংলাদেশে প্রচলিত ২০০৯ সালের ট্রেডমার্ক আইনে মার্ক বলতে কোনো ডিভাইস (Device), ব্রান্ড (Brand), শিরোনাম (Heading), লেবেল (Label), টিকেট, নাম, স্বাক্ষর, শব্দ, প্রতীক, সংখ্যা, সংখ্যাযুক্ত উপাদান, রং এর সমন্বয় বা এগুলোর যে কোনোরূপ সমন্বয়কে বুঝায়। Bata, Lux-এগুলো নাম। মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলা লিংকের ট্রেডমার্কে কয়েকটি রংয়ের সমন্বয় ঘটেছে।
ট্রেডমার্কের মূল বিষয় হলো অন্য পণ্য বা প্রতিষ্ঠান থেকে এর স্বাতন্ত্র্যতা বা ভিন্নতা। এই ভিন্নতা যদি দৃশ্যমান না হয় বা অন্যের পণ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করে অথবা এর উৎপত্তিস্থল বা অন্য কোনো বিষয় জনগণকে বিভ্রান্ত করে তবে তা ট্রেডমার্ক হিসেবে গণ্য হতে পারে না। কেউ যদি 'ঘড়ি' নাম দিয়ে ঘড়ি উৎপাদন
ও বিক্রয় করে তবে ঐ 'ঘড়ি' নাম স্বাতন্ত্র্যসূচক নয়। কারণ অনেকেই ঘড়ি উৎপাদন করছে। আমরা যেভাবে তরি-তরকারি, ফলমূল ইত্যাদি দেখে কিনি ঘড়িতো সেভাবে দেখে কেনা যায় না । ঘড়ির কোন ব্রান্ড বা ট্রেডমার্ক কোন ধরনের মান মেনে চলে ক্রেতা তা জানার চেষ্টা করে। CASIO, ROLEX, TITAN এভাবে ব্রান্ড নামে সে কেনে। একইভাবে কোনো পণ্যের নামের প্রতীক যদি FRANCE দেয়া হয় তবে সেটা ফ্রান্সের তৈরি মনে করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে । তবে সাবানের বা ঘড়ির ব্রান্ড নাম যমুনা হলে সমস্যা নেই ।
ট্রেডমার্ক নিবন্ধন না করেও তা ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের পরেও এক পর্যায়ে তা নিবন্ধন করা চলে । তবে সমস্যা হলো অনিবন্ধিত ট্রেডমার্ক লঙ্ঘিত হলে আইনত তার প্রতিকার দাবি করা যায় না এবং কেউ একবার ঐ নাম নিবন্ধিত করলে তার প্রতিকার লাভ দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই ট্রেডমার্ক নিবন্ধন করাই উত্তম । এর নিবন্ধনও যথেষ্ট সহজ। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অফিস যেখানে অবস্থিত সেখানকার ট্রেডমার্ক নিবন্ধকের অফিসে প্রয়োজনীয় ফি সহ আবেদন করে এরূপ নিবন্ধন করা যায় । তবে এক্ষেত্রে ঐ নামে বা প্রতীকে পূর্বে কোনো নিবন্ধন নেয়া রয়েছে কি না তা আগেই নিবন্ধক অফিস থেকে জেনে নিতে হয়। ট্রেডমার্ক নিবন্ধনের মেয়াদসীমা আইন অনুযায়ী ৭ (সাত) বছর । তবে এরপর থেকে যথানিয়মে ফি দিয়ে তা নবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে নিবন্ধক একই সময়ে ফি নিয়ে ১০ (দশ) বছর পর্যন্ত ট্রেডমার্ক নবায়ন করতে পারেন। যা পরবর্তীতেও চালু থাকে। মধ্যযুগের শুরুতে সর্বপ্রথম রোমান রাজাগণ তাদের ব্যবহার্য তরবারির স্বকীয়তা রক্ষায় ট্রেডমার্কের ধারণার প্রয়োগ শুরু করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ফলে তাদেরকেই ট্রেডমার্কের প্রথম ব্যবহারকারী মনে করা হয়ে থাকে। অবশ্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ ধারণার প্রয়োগ ঘটে শিল্প বিপ্লবকালে। ১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে এ লক্ষ্যে আইন পাস হয়। যুক্তরাজ্যে আইন পাস হয় ১৮৬২ সালে। সর্বপ্রথম বৃটিশ আইনের অধীনে লোগো হিসেবে নিবন্ধন পায় Bass Brewery
যখনই আমরা কোনো একটা ট্রেডমার্কের নাম শুনি বা চোখে দেখি তখনই প্রতিষ্ঠান ও পণ্য সম্পর্কে যে একটা ধারণার জন্ম নেয় তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় বিষয় । একটা ট্রেডমার্ক থেকে এর মালিক, বিক্রেতা ও গ্রাহক সবাই উপকৃত হয়ে থাকে । নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:
১. মালিকের সুবিধা (Advantages of owners ) : একটা নিবন্ধিত ট্রেডমার্কের মালিকের বড় সুবিধা হলো এটি তার প্রতিষ্ঠানের অদৃশ্যমান একটা মূল্যবান সম্পদ। যেই প্রতিষ্ঠান কোনো নাম, প্রতীক বা চিহ্নকে জনপ্রিয় করেছে দীর্ঘকাল তার সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে তার একচ্ছত্র অধিকার থাকবে-এটাই স্বাভাবিক । ট্রেডমার্ক বা ব্রান্ড একটা প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে ব্যবহার করে এর মালিক দ্রুত নতুন নতুন পণ্য বাজারে এনে এ নামের সুফল ভোগ করতে পারে । স্কয়ার কোম্পানি তাদের স্কয়ার নাম ব্যবহার করে যে পণ্যই বাজারে আনুক সাথে সাথে তার একটা ক্রেতাশ্রেণি লাভ করবে। এভাবে ব্রাক আড়ং নামে পোশাক, হস্তজাত সামগ্রী, দুধ ইত্যাদি বাজারজাত করছে। আড়ং ট্রেডমার্ক জনপ্রিয় হওয়ায় তারা এ মার্ক ব্যবহার করে নতুন ব্যবসায়ে হাত দিলে তাতেও দ্রুত সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হবে।
২. ক্রেতা ও ভোক্তাদের সুবিধা (Advantages of customers and consumers) : ট্রেডমার্ক বা ব্রান্ড নামে পণ্য ক্রয় করতে যেয়ে ক্রেতা বা ভোক্তারও অনেক সুবিধা পায় । এরূপ মার্কযুক্ত কোনো পণ্যের মান, মূল্য, স্বাদ, গুণ ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রেতাদের পূর্ব ধারণা থাকায় তারা পূর্বসিদ্ধান্ত নিয়ে সহজেই এরূপ পণ্য সংগ্রহ করতে পারে । ব্রান্ড প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকলে ক্রয় সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। এ ছাড়া ট্রেডমার্কযুক্ত কোনো ব্রান্ড পণ্য কিনলে উক্ত পণ্য যদি নষ্ট, খারাপ বা ব্যবহার অযোগ্য হয় তবে ক্রেতা সেক্ষেত্রে আইনগত সুবিধাও। পেয়ে থাকে । বিভিন্ন ট্রেডমার্কের পণ্য বাজারে থাকায় একজন ক্রেতা স্বনামধন্য পণ্যের ব্রান্ড ব্যবহার করে বা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য ব্যবহার করে নিজের পৃথক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা করতে পারে ।
৩. বিক্রেতাদের সুবিধা (Advantages of sellers): ট্রেডমার্কযুক্ত পণ্য বিক্রয়ে বিক্রেতারাও বিশেষ সুবিধা ভোগ করে । এরূপ পণ্য বিক্রয়ে ক্রেতাদের সাথে তাদেরকে অযথা বাক্য বিনিময় বা দরকষাকষি করতে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রেতা তার পছন্দের ব্রাণ্ডের পণ্য নাম, পণ্যের মূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত থাকায় সে দোকানে যেয়ে তার নির্দিষ্ট ব্রান্ড দেখেই তা থেকে পণ্য ক্রয় করে। মোবাইল ফোন সেট উৎপাদনকারী ব্রান্ড NOKIA, SAMSUNG, SYMPHONY কোনটা একজন গ্রাহক কিনবে সে তা পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। তাই বিক্রেতাকে এ নিয়ে কোনো কথা বলারই তেমন প্রয়োজন পড়ে না । ব্রান্ড পণ্য বাজারে সুখ্যাতি লাভ করলে পরিবেশক, ডিলারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শো-রুম খুলে সহজেই তা বিক্রয় করতে পারে ।
মি. জামান তার দীর্ঘদিনের পাঠদান অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিবিএ সম্মান শিক্ষার্থীদের জন্য। একটা পাঠ্যবই রচনা করে নিজ খরচে তা প্রকাশ করলেন। বইটি বাজারে আসার ক'দিনের মধ্যেই তার বইয়ের। অনেক অংশ হুবুহু নকল করে আগে থেকে বাজারে চালু থাকা বইয়ের একজন লেখক তার বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করলো । মি. জামানের লেখা হুবহু নকল করা হয়েছে-এটার প্রমাণ দেখাতে না পারায় তার সারা জীবনের সাধনা এখন অন্যের সৃষ্টিকর্ম হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। মি. রফিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ফটোগ্রাফীর ওপর কোর্স করে দেশে এসে আবহমান বাংলার বিভিন্ন বিষয়কে তার ছবিতে তুলে এনেছেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্মের গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো কপিরাইট করছেন । একটা ব্যাংক তাদের ক্যালেন্ডার তৈরিতে তার কতকগুলো ছবি প্রকাশ করায় মি. রফিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকার দাবি করেন । ব্যাংক তাঁকে নায্যে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বাধ্য হয়। উভয় ক্ষেত্রেই লেখক শিল্পীর প্রতিকার পাওয়া ও না পাওয়ার পার্থক্য হলো কপিরাইট নিবন্ধন করা ।
লেখক বা শিল্পী কর্তৃক তার সৃষ্টকর্মের ওপর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী আইনগত অধিকারকে কপিরাইট বলে । এটি একটি আইনগত ধারণা। যার উদ্দেশ্য হলো নকল করা থেকে প্রকৃত লেখক, শিল্পী বা সৃষ্টকর্মের স্বত্বাধিকারীর স্বার্থ সুরক্ষা করা; যা না করা হলে এর স্বত্বাধিকারী বা মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কপিরাইটের ধারণা প্রথমত ছাপা বা মুদ্রণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও বর্তমানে যে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। বই, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য, সংগীত কৌশল, অডিও রেকডিং, সাউন্ড রেকডিং, শিল্প সংক্রান্ত নকশা, চিত্রলেখ বিষয়ক নকশা, ফটোগ্রাফস্, স্থাপত্য শিল্পকর্ম, সফটওয়্যার ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সুরক্ষা কপিরাইটের অন্তর্ভুক্ত।
বই লেখকদের আইনগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য বৃটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম ১৬৬২ সালে The Press Act পাস করেন। এতে নিবন্ধিত বইয়ের তালিকা সংরক্ষণের বিধান ছিল । পরে ১৭১০ সালে লেখকসহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের মালিক বা শিল্পীদের উক্ত কর্মের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার সংরক্ষণের জন্য The British Statute of Anne 1710 পাস করা হয়। এতে লেখকদের পাশাপাশি বই প্রকাশকদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অধিকার সংরক্ষণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ লেখক বা শিল্পকর্মের মালিক তার অধিকার অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে বা বিক্রয় করতে পারবে- এই বিধানও এতে সন্নিবেশিত ছিল । ১৭১০ সালে পাস করা এই ডাইনকেই বর্তমানকালের কপিরাইট আইনের ভিত্তি বিবেচনা করা হয়ে থাকে । এখন বাংলাদেশে ২০০০ সালের কপিরাইট আইন (২০০৫ সালের সংশোধনীসমেত) ও কপিরাইট বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় । বর্তমান বিশ্বায়নের এ যুগে কপিরাইট অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে । বাংলাদেশ Universal Copyright Convention 1952 তে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এর বিধানাবলি মেনে চলতে বাংলাদেশ বাধ্য ।
বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিকর্মের ওপর স্বত্ত্বগ্রহীতার মৌলিক অধিকার বা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কপিরাইট আইনের উৎপত্তি । মানুষ যেন সৃষ্টিধর্মী কাজে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তার সৃষ্টিকর্ম থেকে সে লাভবান হতে পারে তা নিশ্চিত করাই এরূপ আইনের উদ্দেশ্য। এ আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সম্পর্কিত (Relatedness with intellectual property): কপিরাইট হলো সৃষ্টিকর্মের ওপর মালিকের আইনগত অধিকার । মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে সৃষ্ট এই কর্ম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত । একজন লেখকের লেখা, কবির কবিতা, গায়কের গান ও নতর্কীর নৃত্যের সিডি, ফটোগ্রাফারের ছবি, পরিচালকের বানানো সিনেমা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত সফটওয়্যার-এর সবই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি । যা কপি বা নকল করে উৎপাদন সম্ভব । এগুলো কপিরাইটের সাথে সম্পর্কিত ।
২. স্বত্বাধিকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ (Maintenance of interest of owners): লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক বা এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ তাদের মেধা, শ্রম ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে যে সৃজনশীল কর্মের জন্ম দেন উক্ত কর্মের ওপর ব্যক্তির স্বত্বগত স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করাই কপিরাইট আইনের মূল্য উদ্দেশ্য। একজনের প্রচেষ্টার ফসল যেনো অন্যে যেয়ে যেতে না পারে, যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই সৃষ্টিকর্ম থেকে যেন তিনিই লাভবান হন- এই আইন তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। স্বত্বাধিকারী যেন লাভবান হয়ে আরও নতুন নতুন কর্ম সৃষ্টিতে উৎসাহিত হয় এ আইন তাও নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালায় ।
৩. নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রয়োগ (Application for particular time period): কপিরাইট আইনে স্বত্বাধিকারীর অধিকার একটা সময় পর্যন্ত সংরক্ষণের নির্দেশ থাকে; যেমন- প্রকাশিত সাহিত্য (বই, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি), নাটক, সঙ্গীত ও শিল্পকর্ম (ফট্রোগ্রাফ ব্যতিত) প্রণেতার মৃত্যুর পরবর্তী ষাট বছর পর্যন্ত কপিরাইট বিদ্যমান থাকে । ফটোগ্রাফ, চলচ্চিত্র ফিল্ম, শব্দ রেকর্ডিং ও ফটোগ্রাফের ক্ষেত্রে তা প্রকাশের বছর থেকে পরবর্তী ষাট বছর পর্যন্ত এই অধিকার প্রযোজ্য। সরকারি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা কর্তৃক সৃষ্টকর্মের কপিরাইটের ক্ষেত্রেও এই মেয়াদ প্রকাশের বছরের পর ৬০ পত্রিকা বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে । প্রকাশিত কর্মের সংস্করণের প্রকাশকের ক্ষেত্রে এই মেয়াদ প্রথম প্রকাশের পর সর্বোচ্চ ২৫ বছর।
৪. কপিরাইট নিবন্ধনের বিষয়টি ঐচ্ছিক (Copyright registration is not compulsory ) : আইনে কপিরাইট নিবন্ধনের বাধ্য-বাধ্যকতা আরোপ করা হয়নি। তবে কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে তা আইনানুগ প্রকাশ্য দলিলের মর্যাদা লাভ করে । অন্যথায় তা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়; যা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল । কে.সি. আগরওয়াল বনাম আনন্দ কুমার মোকদ্দমাসহ বিভিন্ন মোকদ্দমার রায়ে এটা প্রমাণিত যে, কপিরাইট নিবন্ধন না করার কারণে এই আইনে বর্ণিত অধিকার থেকে কপিরাইটের স্বত্বাধিকারীকে বঞ্চিত করা যায় না।
৫. অধিকার ভঙ্গের জন্য শাস্তির নির্দেশ (Indicating the penalty for breach of right) : কপিরাইট ভঙ্গ করা হলে ভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতে হয়। মি. ইমাম একটা বই লিখেছেন। এখন এই বইটা হুবুহু বা আংশিক নকল করে যদি কেউ ছাপে বা মি. ইমামের নামেই নকল বই বাজারে প্রকাশ করে তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হবে। এজন্য আইনে কারাদণ্ড ও জারিমানা বা উভয়বিধ শাস্তির বিধান রয়েছে।
৬. কপিরাইটের স্বত্বনিয়োগ গ্রহণযোগ্য (Assignment of copyright is acceptable ) : সৃজনশীল কর্মের প্রণেতা বা প্রথম স্বত্বাধিকারী তার অধিকার চুক্তিমূলে অন্যের নিকট হস্তান্তর করতে পারেন। একজন লেখক একটা বই লিখেছেন- তিনি এটা প্রকাশের জন্য প্রকাশকের সাথে কপিরাইট চুক্তি করে তাকে তা ছাপার ও পুনঃছাপার অধিকার প্রদান করতে পারেন। একজন বক্তা তার বক্তৃতার সিডি, একজন গায়ক তার গানের সিডি প্রকাশ, প্রচার ও বিক্রয়ের অধিকার অন্যকে দিতে পারেন। এরূপ স্বত্বনিয়োগীও কপিরাইট আইন অনুযায়ী নিবন্ধন করার অধিকার এবং সেক্ষেত্রে কপিরাইট অধিকার ভোগ করে থাকেন।
প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করে প্রণেতা বা আবেদনকারীর নামসহ সৃষ্টিকর্মের নাম ও বিবরণাদি কপিরাইট রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার কাজকেই কপিরাইট নিবন্ধন বলে । কপিরাইট নিবন্ধকের অফিসে আবেদন করে আইনের ধারা অনুযায়ী এরূপ নিবন্ধন কর্ম সম্পাদন করতে হয় । নিম্নে এরূপ নিবন্ধন বিষয়ে ২০০০ সালের কপিরাইট জাইন ও ২০০৬ সালের কপিরাইট বিধিমালায় উল্লেখ প্রয়োজনীয় বিধানাবলি উল্লেখ করা হলো:
১. নিবন্ধনের আবেদন কে করতে পারেন (Who can apply for registration) : কোনো কর্মের প্রণেতা, প্রকাশক বা কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী বা এতে স্বার্থ রয়েছে এমন ব্যক্তি সৃজনশীল কর্মটি নিবন্ধনের জন্য নির্ধারিত ফি প্রদান পূর্বক নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করতে পারবেন ।
২. আবেদন দাখিলের পদ্ধতি (Method of submission of application) : আবেদনকারীকে অত্র বিধিমালার ২য় তফসিলে বর্ণিত ফরম পূরণপূর্বক প্রয়োজনীয় ফি সহ তিন প্রস্থে দাখিল করতে হবে । উল্লেখ্য কপিরাইট নিবন্ধকের অফিস থেকেও এরূপ ফরম সংগ্রহ করা যায়। প্রথম স্বত্ত্বাধিকারীর ক্ষেত্রে এ ফি-এর পরিমাণ ১,০০০ (এক হাজার) টাকা । তবে প্রকাশক বা অন্যদের জন্য লাইসেন্স বা স্বত্বাধিকার নিবন্ধনের বেলায় ফি-এর ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে।
৩. আবেদনপত্রের বিষয়বস্তু (Content of application) : কপিরাইট আইন বিধিমালার ১ম তফসিলের ২নং ফরমে উল্লেখ আবেদনপত্রের বিষয়বস্তু নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
৪. স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহকে আবেদনপত্রের কপি প্রেরণ (Sending the copy of application to the rested groups ) : আবেদনকারীকে এরূপ আবেদনের কপি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ যদি থেকে থাকে তবে তাদের নিকট পাঠাতে হবে । যাতে উক্ত পক্ষ বিষয়টি জানতে পারে এবং এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে তা নিবন্ধক বরাবর উপস্থাপন করতে পারে। একজন গীতিকার গান রচনা করেছেন। সুরকার ও গায়ক অন্য ব্যক্তি হতে পারেন। এক্ষেত্রে গীতিকার কপিরাইটের আবেদন করলে তা অন্য দু'পক্ষকে জানাতে হবে ।
উল্লেখ্য সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, কম্পিউটার সফটওয়্যার, সঙ্গীতকর্ম ও শিল্পকর্মের বেলায় কর্মটি মৌলিক কর্মের অনুবাদ অথবা মৌলিক কর্মের অভিযোজন তার সুস্পষ্ট উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে। অনুবাদ ও অভিযোজন (Addition)-এর ক্ষেত্রে মৌলিক কর্মটির শিরোনাম এবং তার ভাষা, মৌলিক কর্মের লেখক বা প্রণেতার নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা, মৌলিক কর্মটির প্রকাশকের নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা এবং অনুবাদ বা অভিযোজনের ক্ষমতা প্রাপ্তির বিষয়ে অনুমোদনের প্রয়োজনীয় বিবরণসহ ক্ষমতা প্রদানকারীর নাম, ঠিকানা ও জাতীয়তা উল্লেখ করতে হয়।
৫. আবেদনপত্র মূল্যায়ন ও নিবন্ধন সনদ প্রদান (Evaluating application and issuing registration certificate) : কপিরাইট নিবন্ধনের আবেদন প্রাপ্তির পর নিবন্ধক তার বিবেচনায় উপযুক্ত এমন প্রয়োজনীয় তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা বা খোঁজ-খবর করবেন। অতঃপর আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে কপিরাইট রেজিস্ট্রারে কর্মের নাম, শিরোনাম, গ্রন্থকার, প্রণেতা, প্রকাশক এবং কপিরাইটের স্বত্বাধিকারীগণের নাম, ঠিকানা, জাতীয়তাসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লিপিবদ্ধ করবেন এবং আবেদনকারীকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করবেন ।
কপিরাইট আইন অনুযায়ী মৌলিক কর্মের রচিয়তা কর্মটির অনুলিপি তৈরি, প্রকাশ, পুনঃপ্রকাশ, প্রচার, অনুবাদ বা অভিযোজন (Addition) করার একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধিকারী। যথাযথ অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া বা লাইসেন্সে প্রাপ্ত ক্ষমতার বাইরে যেয়ে যদি কেউ উক্ত কর্ম বা এর অংশবিশেষ উৎপাদন, পুনঃউৎপাদন, অনুবাদ বা অভিযোজন কর্ম সম্পাদন করে তবে তা কপিরাইটের লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। এরূপ লঙ্ঘন বা ভঙ্গের পরিণতি প্রতিকার সম্পর্কে আইনে নিম্নরূপ বিধান প্রদত্ত হয়েছে :
তবে চলচ্চিত্রের কপিরাইট বা এতদসংশ্লিষ্ট আইনে বর্ণিত অন্য কোনো অধিকার ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘন করতে কাউকে সহায়তা করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং কমপক্ষে এক বছর মেয়াদে কারাদণ্ড এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামের লঙ্ঘিত কপি অনুলিপি করে প্রকাশ, বিক্রয় বা বিতরণ করলে সেক্ষেত্রে অনুর্ধ চার বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যুন ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং অনুর্ধ চার লক্ষ টাকা ও অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডনীয় হবে ।
টেলিভিশনের একটা বিজ্ঞাপন । বিষয়বস্তু হলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে । টেলিভিশনের পর্দায় এটা দেখে স্ত্রী হা-হুতাশ করছেন। সকল শ্রমিক নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এটাও প্রচারিত হচ্ছে। স্বামী স্ত্রীকে প্রবোধ দিচ্ছেন তাদের ফ্যাক্টরিটি একটা বিমা কোম্পানিতে বিমাকৃত। তাই ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। এই যে সম্পত্তির ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, মানুষ মারা গেলে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা এর সবই বিমার বদৌলতে সম্ভব হচ্ছে।
মানুষের জীবন ও সম্পদকে ঘিরে যে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান তার বিপক্ষে আর্থিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই হলো বিমা। বিমা হলো বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত এক ধরনের চুক্তি যেখানে বিমাকারী প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিমাগ্রহীতার জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি নিজের কাঁধে গ্রহণ করে । সমাজে দু'ধরনের বিমা প্রতিষ্ঠান মূলত কাজ করে । এর একটি হলো জীবন বিমা ও অন্যটি হলো সাধারণ বিমা। জীবন বিমায় মানুষের মৃত্যুজনিত ঝুঁকি মূলত বিমা করা হয়। এটি নিশ্চয়তার চুক্তি। অর্থাৎ বিমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যু হলে বা ব্যক্তি অক্ষম হলে কত টাকা ক্ষতি হবে যেহেতু তা নিরূপণ করা যায় না তাই বিমা কোম্পানি চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি বা নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ব্যক্তি মারা গেলে বা অক্ষম হলে বিমা কোম্পানি প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে। অন্যদিকে সাধারণ বিমা হলো সম্পত্তি বিমা। এটি ক্ষতিপূরণের চুক্তি । অর্থাৎ বিমাকৃত সম্পত্তির আংশিক বা সামগ্রিক যে কোনো ধরনের ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি তা পরিশোধ করে থাকে । নৌ-পথে চলাচলকৃত জাহাজ, জাহাজে বাহিত পণ্য ও মাশুলের জন্য নৌ বিমা, গুদামের মালামাল, কারখানা ইত্যাদির অগ্নিজনিত ক্ষতির জন্য অগ্নিবিমা, সড়কপথে চলাচলকৃত বিভিন্ন যানের জন্য যানবাহন বিমা ইত্যাদি এর বিষয়বস্তু ।
বিমা ব্যবসায়কে ঝুঁকি বণ্টনের ব্যবস্থা নামেও আখ্যায়িত করা হয়। একই ধরনের ঝুঁকির বা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবন ও সম্পত্তি বিমা করার জন্য বিমা কোম্পানি বরাবর হাজির হয়। যদি দেখা যায়, সাধারণত বছরে ১,০০০টা জাহাজ বিমা করা হয়। তবে বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে বিমা কোম্পানি হিসাব করে যে, সর্বোচ্চ কয়টা জাহাজের ক্ষতি হতে পারে বা কী পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ করতে হতে পারে। সেই বিচারে সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে খরচ ও লাভসমেত প্রিমিয়ায়ের একটা পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এই প্রিমিয়ামই হলো বিমা কোম্পানির আয়। যেখানে থেকে ক্ষতি হলে সে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মালিকদেরকে ক্ষতিপূরণ করে । বিমার বিষয়বস্তুতে বিমাগ্রহীতার আর্থিক স্বার্থ বা বিমাযোগ্য স্বার্থ না থাকলে বিমা করা যায় না। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে সদ্বিশ্বাসের সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ফলে একে অন্যকে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সরবরাহে বাধ্য থাকে । বিমা সমগ্র বিশ্বেই এখন অত্যন্ত অপরিহার্য সহায়ক ব্যবসায় কার্যক্রম হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশে ২০১০ সালের বিমা আইন অনুযায়ী এরূপ ব্যবসায় পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ।
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন বন্টন ও এর সহায়ক যে কোনো বৈধ কাজকে ব্যবসায় বলে। ব্যবসায়ের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা। ঝুঁকি বলতে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাকে বুঝায় । এই ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়েই একজন ব্যবসায়ীকে ব্যবসায় করতে হয়। কিন্তু সেই ক্ষতি যদি তার সারা জীবনের সাধনাকে নিমিষেই নিঃশেষ করে দেয়, অজানা আশঙ্কা যদি তাকে সবসময়ই তাড়া করে ফেরে তবে ব্যবসায়ীর পক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় করা সম্ভব হয় না । এই সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্যই বিমা ভূমিকা রেখে চলেছে। নিম্নে ব্যবসায়ে বিমার প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
বিমা করার প্রক্রিয়া বলতে মূলত বিমা চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়াকে বুঝায়। এক্ষেত্রে একদিকে থাকে। বিমাগ্রহীতা- যিনি আর্থিক স্বার্থ রয়েছে এমন জীবন বা সম্পত্তি বিমা করে তার ঝুঁকি বিমা কোম্পানির ওপর অর্পণ করতে চায় এবং অন্যদিকে থাকে বিমাকারী বা বিমা কোম্পানি- যারা প্রিমিয়ামের বিনিময়ে অন্যের জীবন ও সম্পত্তির ঝুঁকি গ্রহণ করে এবং দুর্ঘটনা ঘটলে বা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বা প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকে। এরূপ চুক্তি সম্পাদনে যে সকল পদক্ষেপ সাধারণত গ্রহণ করা হয় তা নিম্নরূপ :
১. প্রস্তাব প্রদান (Offering proposal) : বিমা করতে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জীবন বিমার বেলায় জীবন বিমা কোম্পানি থেকে এবং সম্পত্তি বিমার বেলায় সাধারণ বিমা অফিস থেকে বা তাদের এজেন্ট থেকে প্রস্তাব ফরম সংগ্রহ করে তা পূরণপূর্বক প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দিতে হয় । জীবন বিমার বেলায় বিমাকৃত ব্যক্তির পরিচয়, বয়স, পেশা, শারিরীক সুস্থতা, বিমাপত্রের ধরন, বিমাকৃত অঙ্কের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে। সম্পত্তি বিমার বেলায় সম্পত্তির ধরন, অবস্থান, মূল্য, সম্পত্তির মান, শক্তি ব্যবহারের ধরন, ব্যবহার পদ্ধতি ইত্যাদি নানান বিষয় উল্লেখ করতে হয়। সম্পত্তি বিমার বেলায় আবেদনকারীকে সম্পত্তির ওপর বিষাযোগ্য স্বার্থ রয়েছে তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় মালিকানার ও অন্যান্য দলিল জমা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
২. প্রস্তাব বিবেচনা (Considering proposal): প্রস্তাব ও দলিলপত্র পাওয়ার পর বিমা কোম্পানি প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় কি না এ বিষয়টি বিবেচনা করে । জীবন বিমার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্য, পেশা, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকির মাত্রা বোঝার চেষ্টা করে থাকে। নৌ বিমার ক্ষেত্রে জাহাজের মান, যে পথে জাহাজ চলাচল করে তার ধরন, জাহাজ কোম্পানির পূর্বে ক্ষতি সংঘটনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয় । অগ্নিবিমার ক্ষেত্রে বিমাগ্রহীতার চরিত্র, সম্পত্তির অবস্থান, প্রকৃতি, অগ্নিজনিত ঝুঁকির মাত্রা ইত্যাদি বিষয় বোঝার চেষ্টা করে। জীবন বিমার বেলায় প্রয়োজনে ডাক্তারি পরীক্ষা এবং সম্পত্তি বিমার বেলায় সার্ভেয়ার দিয়ে সম্পত্তির মান, মূল্য ইত্যাদি পরীক্ষা করানো হয়। এতে প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় অন্যথায় তা ফেরৎ দেয়া হয়ে থাকে।
৩. প্রিমিয়াম জমাদানের নির্দেশ ও বিমাপত্র ইস্যু (Order to deposit premium and issuing policy): বিমা কোম্পানি প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে এ বিষয়ে লিখিতভাবে আবেদনকারীকে অবগত করে এবং নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে প্রিমিয়াম জমাদানের নির্দেশ দেয়। বিমা অফিসে প্রিমিয়াম জমা দেয়া হলে তখন থেকেই বিমা চুক্তি কার্যকর হয়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বিমাপত্র ইস্যু করা অনেকসময়ই সম্ভব হয় না। এজন্য কিছু সময়ের দরকার হয় এবং এ সময়ের মধ্যে বিমা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি পত্র ইস্যু করে । অনেক সময় জমা রসিদও এ ধরনের স্বীকৃতিপত্র বিবেচিত হতে পারে। অতঃপর স্ট্যাম্পযুক্ত বিমাপত্র বিমা কোম্পানি থেকে ইস্যু করা হয়। এতে বিমাকৃত বিষয়বস্তু, বিমাকৃত বিপদ বা ঝুঁকিসহ প্রয়োজনীয় সকল বিষয় লেখা থাকে ।
পরিবেশের সাথে প্রাণীজগত ও তার পারিপার্শ্বিকতার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক বিরাজমান তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত আইনসমূহকে পরিবেশ আইন বলে । মানুষের উপজীবিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো ব্যবসায় । এই ব্যবসায়ের ওপর যেমনি প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক বিভিন্ন পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য তেমনি ব্যবসায়ের দ্বারাও পরিবেশ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় । গাছ কেটে ইটের ভাটায় জ্বালানির যোগান দিচ্ছে মানুষ। এতে বন ও গাছ-গাছালি কমে যাওয়ায় পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ইটের ভাটা থেকে নির্গত ধুয়া বায়ু দূষণ করে পরিবেশের ক্ষতি করছে। পোড়া ইটের টুকরা মাটির সাথে মিশে মাটি দূষিত হচ্ছে। এভাবে দেখা যাবে মুনাফা অর্জনের জন্য একজন ব্যবসায়ী পরবর্তী ফলাফল বুঝে বা না বুঝেই পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। রাস্তায় পরিবহণের গাড়ি চলছে এতে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণসহ পরিবেশে তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শিল্পবর্জ্য নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে পানিতে। এতে পানি দূষণ হচ্ছে। এভাবে ব্যবসায় কার্যক্রম এখন পরিবেশ বিনষ্টের মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন পরিবেশ আইনের এবং তার কঠোর অনুশীলনের।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশ দূষণের বিষয়টি সমগ্র বিশ্বেই এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় । সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য ও সেবার যোগান দিয়ে চলেছে ব্যবসায়। মানুষের ভোগের প্রবণতা বাড়ায় শিল্পোৎপাদন বেড়েছে ব্যাপক হারে। নানান ধরনের সেবা শিল্পের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা । কত কম খরচে পণ্য উৎপাদন করে বাজার দখল করা যায়-এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। কিন্তু তার এ কাজ পরিবেশের ওপর কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এটা বোঝার কোনো সময় ও সুযোগ তার নেই । বাংলাদেশে বর্জ্য শোধন যন্ত্র (Effluent Treatment Plant /ETP) প্রতিষ্ঠা ছাড়া শিল্প অনুমোদন না দেয়ার বিধান থাকলেও তা কতটা মানা হচ্ছে তা দেখার যেন কেউ নেই । এভাবেই সবার চোখের সামনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নানানভাবে পরিবেশ দূষণ করে চলছে । নিয়ে ব্যবসায় কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের দূষণ সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো;
১. শব্দ দূষণ (Sound pollution) : পারিপার্শ্বিকতায় শব্দ ও কোলাহল বেড়ে যাওয়ার কারণে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে যে অস্বাভাবিকতার জন্ম নেয় তাকে শব্দ দূষণ বলে। শান্ত ও নিরিবলি পরিবেশ মানুষসহ সকল সৃষ্টিকূলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ । ব্যবসায়ের উন্নয়ন এবং বাজার ও শহর সৃষ্টি শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ। উড়োজাহাজ উঠছে ও নামছে এতে শব্দ দূষণ ঘটছে। রেলগাড়ি, বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের পরিবহন শব্দ দূষণের কারণ । গাড়ির হর্ণ ঢাকা শহরে অসহ্য । মেশিনের শব্দ, বুলডোজার ও ড্রিলের শব্দ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি নানান কাজে শব্দ দূষণ ঘটছে । গ্রামের বাজারে উচ্চ আওয়াজে দোকানে সিডি বাজছে, মাইকিং হচ্ছে- এগুলোও শ দূষণের কারণ হিসেবে গণ্য ।
২. পানি দূষণ (Water pollution) : পানির স্বাভাবিকতায় প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকরণের কাজকেই পানি দূষণ বলে । পানির অপর নাম জীবন। পানি তার স্বাভাবিকতা হারালে প্রাণীজগত ও সৃষ্টিকূলের জন্য তা কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে ঢাকার আশে পাশের নদীগুলো দেখলেই আমরা তা বুঝতে পারি। সৃষ্টিতে পানির অপরিহার্যতার কারণেই সৃষ্টিকর্তা হয়তোবা তিনভাগ জল ও একভাগ স্থল সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জীবন ধারণ ও কর্মকাণ্ডের প্রতিটা মুহূর্তেই পানির যে প্রয়োজন তা আমাদের সবার নিকট দৃশ্যমান। অথচ এই পানিতে হাড়ি-বাসন ধোয়া, কাপড়-চোপড় ধুয়ে ক্ষার পানিতে ছেড়ে দেয়াসহ অসংখ্য পানি দূষণের কাজ হচ্ছে। শিল্পবর্জ্য, পয়ঃময়লা যখন নির্দ্বিধায় পানিতে ছেড়ে দেয়া হয় তখন ঐ পানি মানুষের জন্য আর উপকারী থাকে না। নদীতে ও সমুদ্রে জলযান চলছে। তৈল, ময়লাসহ নানান আবর্জনা ফেলা হচ্ছে পানিতে। তৈল ট্যাংকার ফেটে ও খনি থেকে তৈল নির্গত হচ্ছে পানিতে। এতে পানি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। এভাবেই ব্যবসায় কর্মকাণ্ড পানি দুষম বিরূপ ভূমিকা রাখছে।
৩. বায়ু দূষণ (Air pollution) : স্বাভাবিক উপাদানের বাইরে বায়ুতে যখন নানান ধরনের ধুয়া, গ্যাস, ধুল বালি, সিসাসহ নানান খারাপ উপাদান যুক্ত হয় তখন তাকে বায়ু দূষণ বলে। মানুষ ও প্রাণীজগতের সুস্থ র স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । গাছপালাও তার প্রয়োজনীয় উপাদান নিচ্ছে বায়ু থেকে । কিন্তু ব্যবসায় আজ এই নির্মল বায়ু থেকেও মানুষকে বঞ্চিত করছে । ঢাকা শহরের কথাই যদি ধরা হয় তবে পরিবহণের গাড়িগুলো প্রতিদিন যে পরিমাণ ধুয়া ছড়াচ্ছে তাতে ঢাকার বাতাস দুষিত হচ্ছে। ইটের ভাটা আমাদের দেশের বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। শিল্প কারখানার ধুয়া, ধুলা-বালি, পরিবহণের ধুয়া থেকে নির্গত সিসা ইত্যাদি বায়ু দূষণ করছে। জুম চাষের জন্য বন পোড়ানো হচ্ছে, দাবানল সৃষ্টি হচ্ছে এতেও বায়ু দূষণ ঘটছে ।
৪. মাটি দূষণ (Soil pollution): উর্বর মাটি যখন নানান খারাপ উপাদানযুক্ত হয়ে তার স্বাভাবিকতা হারায় তখন তাকে মাটি দূষণ বলে। আবহমান কাল থেকে এই মাটি মানুষের খাদ্য যোগানে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গাছ-পালা, ফল-মূল সবই এই মাটি থেকে সৃষ্ট। কিন্তু এই মাটিও আজকে ব্যবসায় কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণের অসহায় শিকার। কৃষি ফার্মগুলো অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করে মাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিল্পব জমিতে ফেলে মাটির ক্ষতি করা হচ্ছে। ইটের ভাটার টুকরো ইট মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করছে। খনি থেকে সম্পদ আহরণের ফলে জমি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি এ সকল খনিজ পদার্থ মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক মাত্রায় উঠিয়ে ফেলার কারণে মাটির শুষ্কতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচ দিয়ে যখন বিদ্যুত, গ্যাসসহ নানান সংযোগ লাইন টানা হচ্ছে তাতেও মাটি তার স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে।
মি. রাইয়ান মানসম্মত পণ্য ও সেবা কেনার বিষয়ে খুবই আগ্রহী । বাজারে যেভাবে ভেজালের সয়লাব চলছে, খাবারে যেভাবে নানান অস্বাস্থ্যকর রাসায়নিক সামগ্রী মেশানো হচ্ছে, মুখে মিষ্টি কথা বলে সেবা প্রদানে যেভাবে ঠকানো হচ্ছে, চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিলেও কথা ও কাজে যখন হর-হামেশা অমিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তখন মি. রাইয়ান কোথায় ভালো পণ্য ও সেবা পাবেন সে বিষয়ে সবসময়ই সতর্ক থাকেন। প্রতিষ্ঠানের মান যাচাই করতে চেষ্টা করেন। আর এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও পণ্যমানের যথার্থতার সনদ প্রদানের বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে কাজ করে এটাও তার জানা । ISO এমনই একটা প্রতিষ্ঠান।
একটা প্রতিষ্ঠান কতটা মানসম্মত পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে এবং তাদের ব্যবস্থাপনার মান কেমন এ বিষয়ে সনদ প্রদানকারী একটা আস্তর্জাতিক মান প্রতিষ্ঠানই হলো ISO (International Standard Organization, যার পরিবর্তিত নাম International Organization for Standardization)। ISO সর্বপ্রথম সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে ISO ৯০০০ নামে একটা মান নির্দিষ্ট করে তা অর্জনের যোগ্যতা ও গুণাবলি নির্দিষ্ট করে সংশ্লিষ্ট দলিলাদি প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হয়। এ সময় থেকেই যারা এই মান অর্জন ও বজায় রাখতে সক্ষম তাদের একটা সময়কাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে এই মান সনদ দেয়ার কাজ শুরু হয়। ইউরোপ, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এই মান সনদ লাভে আগ্রহ প্রকাশ করায় দ্রুত তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানও ইতোমধ্যে এ সনদ লাভ করেছে। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মান নির্দিষ্ট করে ৯০০১, ৯০০২, ৯০০৩, ৯০০৪ নামে মান সনদসহ বিভিন্ন মানসনদ চালু করা হয়েছে। ইদানিং ২০১৪ নামে আরেকটি মান সনদ চালু হয়েছে। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
১. ISO 9000 মান সনদ: ISO 9000 হলো একসেট মানদণ্ড, যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বা সেবার আন্ত জাতিক মান নিশ্চিত করে। এটি মান কর্মসূচির একটি সনদ, যা এর বিশেষজ্ঞরা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম পরীক্ষার পর প্রদান করেন। এ সনদের জন্য প্রতিষ্ঠানকে কতকগুলো প্রয়োজনীয় শর্ত মেনে চলতে হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান ISO 9000 হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ক্রেতারা এর মান সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা অর্জন করে । ISO 9000 উৎপাদককে সব সময় ক্রেতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য পণ্যমান নিশ্চিত করতে হয় । ISO 9000 প্রকৃতপক্ষে ৫টি সনদ দ্বারা গঠিত। এগুলো হলো- ISO 9000, ISO 9001, ISO 9002, ISO 9003, এবং ISO 9004 ।
২. ISO 14000: ISO 14000 একটি পরিবেশ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম। ১৯৯৬ সালে International organization for standardization একসেট নতুন মানদণ্ড প্রবর্তন করে, যার নাম ISO 14000 । ISO 14000 পরিবেশ সম্পর্কিত দায়িত্বের শর্তাবলির উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যসম্পাদন (Performance) নির্ধারণ করে। প্রাথমিকভাবে, ISO 14000 একটি স্বেচ্ছামূলক দিকনির্দেশনা এবং সনদপত্র কর্মসূচি হিসেবে শুরু করা হয়। এ সনদপত্রের মানদণ্ড ৪টি প্রধান দিক চিহ্নিত করে। এগুলো হলো-
পণ্যমান নিয়ে সকল মানুষই এখন সচেতন । এই মান নিশ্চিত করার জন্য সবদেশেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে । বাংলাদেশে BSTI এমন একটা প্রতিষ্ঠান। বর্তমান বিশ্বায়নের এ যুগে আন্তর্জাতিক পণ্য ও সেবার মান নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক। সে অবস্থায় এরূপ মান বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান সনদ দেয়ার মর্জে যোগ্যতাসম্পন্ন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ISO এ ধরনেরই একটা বেসরকারি সংস্থা (NGO) । নিম্নে এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো :
ভালো মানের পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে ISO এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । শুধুমাত্র পণ্য ও সেবার উপাদানগুলো বিবেচনা করেই নয় এর বাইরেও পণ্য ও সেবার মান ধরে রাখতে যে সকল বিষয় ভূমিকা রাখে তা দেখার কারণে ISO মান সনদ আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সমাদৃত ।
ISO সনদ প্রত্যাশী প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মান দেখার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার মান, কর্মীদের মান, কার্যপদ্ধতি ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশের বিভিন্ন দিকগুলো বিবেচনা করায় এটা একটা প্রতিষ্ঠানের round নৈপুণ্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে ।
মানুষ পণ্য কেনে প্রয়োজন পূরণের জন্য। কিন্তু কোন পণ্য প্রয়োজন পূরণে কতটা সমর্থ তা মানুষের পক্ষে সর্বত্র বুঝে নেয়া সম্ভব হয় না। চাল, ডাল, মরিচ, তরকারি ইত্যাদি দেখে কেনা যায়। কিন্তু যখন মরিচের গুড়া কেনা হয় তখন এ গুড়ার প্যাকেটে আরো কিছু মেশানো হয়েছে কি না এটা দেখার উপায় নেই । কেউ টেলকম পাউডার কিনবে। এখন এর মধ্যে কী আছে, কতটা ত্বকের জন্য উপযোগী এটাতো বোঝা যাবে না । এভাবে = নানান সামগ্রী আমরা যা কিনি তার মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বা মানসম্মত পণ্য সামগ্রী যাতে ভোক্তাসাধারণ ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য সরকার যে সংস্থাকে এরূপ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে তাই বি.এস.টি.আই নামে পরিচিত ।
বাংলাদেশের পণ্যের মান নির্ধারণ, পণ্যমান পরীক্ষা ও মান নিশ্চিত করার জন্য যেই সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মরত রয়েছে তাকে বিএসটিআই বলে। ১৯৮৫ সালে সরকার এক অর্ডিন্যান্স বলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ইনস্টিটিউশন ও সেন্ট্রাল টেস্টিং ল্যারবেটরিজ নামক দু'টি প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে বর্তমান বি.এস.টি.আই নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এর উদ্দেশ্য হলো শিল্প, খাদ্য ও রসায়নিক পণ্যের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের জন্য একটা জাতীয় মান তৈরি করা এবং ঐ মান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। একই সাথে মেট্রিক পদ্ধতি চালু এবং ওজন ও পরিমাপের যথার্থতা দেখাশুনার দায়িত্বও এ প্রতিষ্ঠানের ওপর ন্যস্ত করা হয় । এছাড়াও সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে যে সকল পণ্যের জন্য বাধ্যতামূলক মান নিবন্ধনের নির্দেশ দেবে সেটার মান পরীক্ষা করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করাও এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। বাংলাদেশে এ প্রতিষ্ঠানটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটা প্রতিষ্ঠান ।
ষোলো কোটি মানুষের এ দেশে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবার মান নির্দিষ্টপূর্বক তার যথার্থতা নিশ্চিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান BSTI । আমাদের দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা ততটা সংহত নয়। গ্রামে-গঞ্জে যে যেভাবে পারে পণ্য উৎপাদন করে তা বাজারজাত করে। ক্রেতাসাধারণও পণ্যমান সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় এরূপ পণ্য বাজারে অবাধে বেচাকেনা হয়। তারপরও এর মধ্যেই BSTI তার সামর্থ্য মতো কাজ করে চলেছে। নিম্নে এর কার্যাবলি উল্লেখ করা হলো:
আরও দেখুন...